জামিন জালিয়াতির কারসাজি
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
জামিননামা আদালত থেকে কারাগারে পৌঁছানোর সময় বহনকারীর সঙ্গে যোগসাজশেই বড় রকমের জালিয়াতি হয়। অনেক ক্ষেত্রে জালিয়াত চক্র ভুয়া জামিননামা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করে সন্ত্রাসী-দাগি আসামিদের মুক্ত করে নেয়। জামিননামা আদালত থেকে ডাকযোগে বা সংশ্লিষ্ট আদালতের পত্রবাহকের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তা মানা হচ্ছে না। বিচারকের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুমতি ছাড়াই এক আদালতের কর্মচারী অন্য আদালতের কর্মচারীদের দিয়ে আসামির জামিননামা কারাগারে পৌঁছে দিচ্ছেন। কারা কর্তৃপক্ষও দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক ছাড়াই আদালত কর্মচারীদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ জামিননামা গ্রহণ করছে। আর এ কারণেই জামিন জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম ঘটছে। দুর্নীতির উদ্দেশে আদালতের কিছুসংখ্যাক কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে এ অনিয়ম চালিয়ে আসছেন।
২০১৫ সালে ঢাকার আদালতের ৭৬টি মামলার ১০৬ আসামিকে জালিয়াতির মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়ার ঘটনা সবচেয়ে বড় জামিন জালিয়াতি ছিল। আর এ বছর ৩০ আগস্ট ভুয়া জামিননামায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে গ্রেফতার মিজান মাতুব্বর। এ জালিয়াতিতে এক আদালতের কর্মচারী অন্য আদালতের কর্মচারীদের দিয়ে আসামির জামিননামা পৌঁছে দেয়ার সময় একটি চক্র যোগসাজশে ভুয়া জামিননামা কারা কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। এমন ভয়াবহ অনিয়মের হাত থেকে রেহাই পেতে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকায়নের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দৃশ্যত দুর্নীতির (জালিয়াতি) জন্যই আদালতের কর্মচারীরা কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে এ জালিয়াতি করে আসছেন। আসামির জামিননামা ডাকযোগে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত পত্রবাহক দিয়ে না পাঠিয়ে অন্যদের দিয়ে পাঠালে এতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে। আধুনিক যোগাযোগ যেমন- ইমেইলের মাধ্যমে আদালত থেকে কারাগারে আসামির জামিননামা অথবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো যেতে পারে। এতে কাজে গতির পাশাপাশি জালিয়াতি অনেকাংশে রোধ হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট আদালতের পত্রবাহক ছাড়া অন্য কেউ জামিননামা দাখিল করলে তেমন জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে জালিয়াতি করেও শাস্তি হয় না। আর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ অনিয়মের সুযোগ নিচ্ছেন দুর্ধর্ষ আসামিরা। তারা কারা কর্তৃপক্ষ ও আদালতের কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে জামিন জালিয়াতির মতো গুরুতর অপরাধ করছে। এ বছরের ৩০ আগস্ট ভুয়া জামিননামায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়েছে মিজানুর রহমান ওরফে মিজান মাতুব্বর। ২৫ সেপ্টেম্বর এ ঘটনায় আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। এ ক্ষেত্রেও জামিননামা হাত বদলের মাধ্যমেই জালিয়াতি করে মিজান মাতুব্বরকে কারামুক্তি দেয়া হয়। এ জালিয়াতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে দীর্ঘদিনের এ অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে। দীর্ঘদিনের এ অনিয়মের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে ভবিষ্যতে আর এমন অনিয়ম করতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলী মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, আসামির জামিননামা অবশ্যই ডাকযোগে অথবা সংশ্লিষ্ট আদালতের পত্রবাহকের মাধ্যমে কারাগারে পাঠাতে হবে। অন্য আদালতের স্টাফ দিয়ে এ জামিননামা পাঠানোর নিয়ম নেই। কোনো আসামির জামিনের বিষয়টি সন্দেহ হলে অবশ্যই কারা কর্তৃপক্ষের উচিত টেলিফোনের মাধ্যমে আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়েছে কিনা- তা যাচাই করা। যাচাই-বাছাই ছাড়া আসামিকে কারামুক্তি দেয়া হলে কারা কর্তৃপক্ষও এর দায় এড়াতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারা কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আদালত থেকে কারাগারগুলোতে কর্মচারীদের কোনো তালিকা দেয়া হয় না। ফলে কে আদালতের কর্মচারী আর কে কর্মচারী নয়- তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি যাচাই করা কঠিন। এছাড়া যে কোনো দুর্ধর্ষ আসামি কারাগারে পাঠানো হলে নিয়ম অনুসারে কোর্ট ইন্সপেক্টরা কারাগারকে পৃথকভাবে চিঠি দিয়ে জানাবে। কিন্তু সে কাজটিও করা হচ্ছে না। ফলে নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়েই কারা কর্তৃপক্ষকে কাজ করতে হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির বলেন, অধিকাংশ জামিননামাই আদালতের কর্মচারীদের মাধ্যমে আদালতে আসে। তবে ডাকযোগে আসা জামিননামার সংখ্যা নিতান্তই কম। আর সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারীর বদলে অন্য আদালতের কর্মচারীর জামিননামা নিয়ে আসার দীর্ঘদিনের এ অনিয়মটি আর চলতে দেয়া হবে না। এখন থেকে কারাগারে সংশ্লিষ্ট আদালতের পত্রবাহক ছাড়া অন্য কোনো লোকের মাধ্যমে জামিননামা গ্রহণ করা হবে না।
এদিকে ভুয়া জামিননামায় মিজান মাতুব্বরের কারামুক্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার তার লিখিত বক্তব্যে জানান, ৩০ আগস্ট আদালতের পত্রবাহক তৈয়বের মাধ্যমে আসামি মিজানের জামিননামা ও রিলিজ আদেশ পাওয়া যায়। ওই দিনই তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ঢাকার চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ফোরকান মিয়া বলেন, তৈয়ব নামে এ ট্রাইব্যুনালে কোনো কর্মচারী নেই। ট্রাইব্যুনাল থেকে ওই জামিননামা পাঠানো হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তৈয়ব ঢাকার চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নন। তিনি ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের নাইট গার্ড। তৈয়ব বলেন, ‘আদালতের (ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল) জারিকারক কবিরের মাধ্যমে কয়েকজন আসামির জামিননামা পাই। ৩০ আগস্ট ঢাকার চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তিনটি জামিননামা ও পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের চারটি জামিননামা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দিই। তবে চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কোনো জামিননামাই আমি কারাগারে দাখিল করিনি। চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জামিননামাগুলো দাখিল করেছিল জারিকারক কবির। এছাড়া জামিননামাগুলো সন্ধ্যা ৬টার দিকে দাখিল করি। আর ভুয়া জামিননামাটি এরপর দাখিল করা হয়েছে। ভুয়া জামিননামার স্বাক্ষরের সঙ্গে আমার স্বাক্ষরের মিল নেই। তৈয়বের হাজিরা বইয়ে স্বাক্ষরের সঙ্গে ওই স্বাক্ষরের মিল নেই। আরও জানা যায়, ওই দিন (৩০ আগস্ট) ঢাকার চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাতটি জামিননামা কারাগারে দাখিল করেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের জারিকারক কবির। তিনি যুগান্তরকে বলেন, চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জারিকারক ফারুক ওই জামিননামাগুলো কারাগারে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাকে দিয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো আদালতের বিচারকের অনুমতি নেয়া হয়নি। চার নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জারিকারক ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়াই অন্য আদালতের কর্মচারীদের দিয়ে আমি জামিননামা কারাগারে পাঠিয়েছি।’
জাহাঙ্গীর কবির বলেন, জালিয়াতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভুয়া জামিননামায় তৈয়বের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে সেটা তৈয়বের কিনা তা যাচাই করতে হবে। এছাড়া ঘটনার দিন তৈয়ব ও ওই আদালতের আরেক কর্মচারী কবিরকে কারাগারের সিসি টিভি ফুটেজে প্রবেশ করতে ও বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। যে টেবিলে জামিননামা দাখিল করা হয়। সেই টেবিলটি সিসি টিভির আওতার বাইরে বলে ভুয়া জামিননামাটি কে দাখিল করেছে তা দেখা যায়নি। তবে আদালতের কর্মচারীর সহায়তা ছাড়া এ জালিয়াতি সম্ভব নয়। এক আদালতের পিয়ন তিন-চারটা আদালতের জামিননামা কারাগারে নিয়ে আসেন। এমন হলে অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
যে মামলার আসামি মিজান মাতুব্বর : ২০১৫ সালের ২ মে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের স্টাফ রোড এলাকা থেকে আট বছরের শিশু আবীরকে প্রাইভেটকার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যায় অপহরণকারীরা। এরপর মুক্তিপণ হিসেবে ১০ কোটি টাকা দাবি করা হয়। পরে একাধিক ব্যাংকের হিসাবের মাধ্যমে এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং নগদ ২৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে অপহরণকারীরা শিশু আবীরকে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনায় আবীরের মামা এনায়েত উল্লাহ রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। এ মামলার প্রধান আসামি মিজানুর রহমান ওরফে মিজান মাতুব্বর। তদন্তে র্যাব পাঁচ আসামিকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে।
সর্বাধিক আলোচিত জামিন জালিয়াতি : পুরান ঢাকার আদালতের ৭৬টি মামলার মোট ১০৬ আসামিকে জালিয়াতির মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়ার ঘটনা সব চেয়ে বড় ধরনের জামিন জালিয়াতি। চলতি বছরের ২২ মার্চ চাঞ্চল্যকর এ জালিয়াতি মামলার রায় ঘোষণা হয়। রায়ে আদালতের পাঁচ কর্মচারীকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট আদালতের কর্মচারীদের যোগসাজশে ৭৬টি মামলায় অবৈধভাবে জামিননামা তৈরি করে ১০৬ আসামিকে মুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন নাজির মো. উবায়দুল করিম আকন্দ বাদী হয়ে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলাটি ছাড়া বর্তমানে জামিন জালিয়াতির একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। হত্যা মামলার আসামি ড. সাইফুল্লাকে জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের ভুয়া জামিননামা বিচারিক আদালতে দাখিল করলে তা বাদীপক্ষের নজরে আসে। বাদীপক্ষ ভুয়া জামিননামার বিষয়ে আদালতে অভিযোগ করলে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।